রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০৫:৫৩ অপরাহ্ন

একজন ‘প্রধান মুফতি’র বিদায়

একজন ‘প্রধান মুফতি’র বিদায়

শরিয়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে যে ধরনের পরিভাষা ব্যবহার করা হয়, অনেকেই সেগুলোর মূল্য ও গুরুত্ব বুঝতে পারেন না। সাধারণ এক-দুটো শব্দও কত বিপুল মাহাত্ম্য ধারণ করে তা হয়ত বিশদ ব্যাখ্যা করেও বোঝানো যাবে না।

যে কোনো স্বতন্ত্র জগতেই নানা পরিভাষা রয়েছে। সেসব জগতের সঙ্গে কোনোভাবে সম্পৃক্ত থাকার প্রয়োজন দেখা দিলে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, সে সংশ্লিষ্ট পরিভাষা ও নূন্যতম জ্ঞানের অভাব দূর করা।

একজন মেডিকেল ডাক্তার পরিচয়মূলক যে পরিভাষা ধারণ করে আছেন, ডাক্তারের অবস্থান জানতে হলে আমাকে সে পরিভাষার আদ্যোপান্ত জানতে হবে। কারো কোন পদের বিষয়ে আমার জানাশোনা না থাকলে আমি সে পদের ব্যক্তিটির যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারব না৷ এটি পৃথিবীর চলমান ব্যবস্থার এক অনিবার্য রীতি।

যেহেতু সাধারণ মানুষ থেকে নিয়ে আমরা সকলেই, নানাভাবেই ধর্মের মুখাপেক্ষী, ফলে ধর্মীয় পরিচয়মূলক পরিভাষাগুলোর যথার্থ জ্ঞান আমাদের থাকা জরুরি। যাতে করে কেউ এই উপাধিগুলোর অপব্যবহার করতে না পারে।

বাংলাদেশের ‘মুফতি আজম’ ইন্তেকাল করেছেন। এটি শুনতে খুব স্বাভাবিক শোনালেও এর পেছনে গভীর বেদনার পাশাপাশি শূন্যতা লুকিয়ে আছে। আমরা হয়ত জানি না, মুফতি আজম বা প্রধান মুফতি কাকে বলে।

এই পরিভাষার গুরুত্ব ও ইতিহাস আমাদের জানা থাকলে শিরোনাম থেকে আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যেত, একজন মুফতি আজমের বিদায় কি অসীম শূন্যতা সৃষ্টি করবে চলমান সমাজে।

খবরটি অনেকের কাছেই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের জন্য এ মুহূর্তে এরচেয়ে কষ্টের সংবাদ আর হতে পারে না। একজন মুফতি আজম শরিয়া সংশ্লিষ্ট মতামত প্রদানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য ভূমিকা রাখেন। ধর্মের কোন বিষয়ে যখন মতানৈক্য দেখা দেয় তখন তার কথাকেই আমলে নিতে হয়।

চট্রগ্রামের হাটহাজারীর মুফতি আব্দুস সালাম (রহ.) ছিলেন এদেশের মুফতি আজম। বাংলাদেশের ইতিহাসের তিনি সেই গ্রহণযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। শরিয়া বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষেত্রে তার অতুলনীয় দক্ষতা ও তৎপরতা উল্লেখযোগ্য। ধর্মীয় অঙ্গনে এই স্কলারের মৃত্যু এক গভীর শূন্যতা ও অভাব সৃষ্টি করবে।

সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন সিনিয়র আলেম ইন্তেকাল করেছেন। তাদের প্রত্যকেই নিজস্ব যোগ্যতার কারণে এমনসব উপাধির অধিকারী ছিলেন, বর্তমান প্রজন্মের কেউ আদৌ তা অর্জন করতে পারবে কি না সে নিশ্চয়তা দেয়া যায় না।

আল্লাহতায়ালা কবুল করলেই এই পরিভাষা বা উপাধিগুলো অর্জনে আসে। দরকার শুধু— একনিষ্ঠতার সঙ্গে দ্বীন ও ইলমের জন্য সাধনা।

আমাদের গত হওয়া মুরুব্বি আলেমদের মধ্যে দ্বীনের প্রতি যে একনিষ্ঠ মনোভাব ও দায়িত্বশীলতা ছিল তা বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

মুফতি আব্দুস সালাম ছিলেন একজন সফল ইসলামি অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশ পেরিয়ে বহির্বিশ্বের অনেক দেশেও তার এই পরিচয়টি ব্যাপকভাবে সমাদৃত। যে সময়ে তিনি ইসলামি অর্থনীতি নিয়ে কাজ করেছেন তখন খুব অল্প সংখ্যক আলেমই এই সাবজেক্ট নিয়ে কাজ করেছেন। এটি তার দূরদর্শী চিন্তার বাস্তবিক উদাহরণ। একজন আলেমকে যথাযথ প্রয়োজনের সময় যথার্থ পদক্ষেপটিই নিতে হয়।

তিনি ছিলেন সময়ের আলেম। সময়ের প্রয়োজনে সঠিক মাসআলা অনুসন্ধানই ছিল তার জীবনের লক্ষ্য। এজন্য তিনি কোনো ধরনের সামাজিক প্রলোভন বা প্রতারণার ফাঁদে পা দেননি। শরিয়া অনুযায়ী যে সিদ্ধান্ত আসে, তিনি তা অত্যন্ত সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করতেন। এটি একজন সত্যিকার আলেম ও মুফতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আজীবন এই বৈশিষ্ট্যের উপর পাহাড়ের মত অটল ছিলেন মুফতি আবদুস সালাম রাহিমাহুল্লাহ।

মুফতি আবদুস সালাম পাকিস্তানের ‘জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া বানুরি টাউন’ মাদ্রাসায় ৩০ বছরের মত দীর্ঘসময় অধ্যাপনা করেছেন। ফতোয়া বিভাগের মত এমন স্পর্শকাতর পদে এত দীর্ঘসময় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করা এক বিস্ময়কর ব্যাপার।

তিনি যখন বানুরি টাউনে ইফতা বিভাগের অধ্যাপনা করেন, তখন সময়টা ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং, অসংখ্য আলেম ও মুফতির সমাগম ছিল পাকিস্তানে। সে সময়ে একজন ভিনদেশি হয়ে এভাবে সবার মাঝে প্রধান মুফতি হয়ে ওঠা নিঃসন্দেহে তার কঠিন পরিশ্রম ও প্রচেষ্টার ফল।

শুরুতে ইফতা বিভাগে সাধারণ অধ্যাপক বা শিক্ষক পদে দায়িত্ব পেলেও ধীরে ধীরে তিনি ইফতা বিভাগের পূর্ণ দায়িত্ব পেয়ে বানুরি টাউনের প্রধান মুফতির পদে আসীন হন। এই পদে সমাসীন ব্যক্তি সর্বোচ্চ সম্মান পেতেন । এটি এমন এক সম্মান ও যোগ্যতার স্বাক্ষর যা আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ তাওফিকের মাধ্যমেই কেবল সম্ভব হয়।

দায়িত্বকালে তিনি অসংখ্য ফতোয়া প্রদান করেন। মৌখিক ফতোয়ার বিপুল সংখ্যার গণনা তো সম্ভবই নয়, লিখিত ফতোয়ার সংখ্যাও বিপুল পরিমাণে রয়েছে। জামিয়া বানুরি টাউনের রেজিস্ট্রি বুকের তথ্যমতে তাঁর লিখিত ফতোয়ার সংখ্যা তিনলাখেরও বেশি।

সামান্য একটি ফতোয়া লিখতে যেখানে একজন মুফতির রাতদিন পরিশ্রম করতে হয় সেখানে মুফতি আব্দুস সালাম অসংখ্য ফতোয়া প্রদান করে গেছেন মুসলিম উম্মাহর উদ্দেশ্যে। এটি মুসলিম উম্মাহর জন্য বিরাট প্রাপ্তি।

মুফতি রাহিমাহুল্লার পড়াশোনার আগ্রহ ছিল প্রচুর। যেকোনো জিনিস খুঁজে বের করবার জন্য তিনি বিপুল পড়াশোনা করতেন। সর্বক্ষণ কিতাবের পাতায় বুঁদ হয়ে থাকতেই যেন তিনি পছন্দ করতেন। তরুণ বয়সে তিনি আল্লাহর কাছে কেবল একটি জিনিসই চেয়েছেন, একটি রুমে অসংখ্য কিতাব, চারদিকে কেবল বই আর বই, এরমধ্যে তিনি বইয়ের পাতায় ডুবে আছেন।

এই একটি দৃশ্য কল্পনা করতেন আর আল্লাহর কাছে চাইতেন। আল্লাহ যেন সে দোয়াই কবুল করেছেন৷ এর পরপরই তিনি বানুরি টাউনের মত ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানে ফতোয়া বিভাগে মুফতি নিযুক্ত হন।

সারাজীবন তিনি এমনসব কাজকর্মে যুক্ত ছিলেন যার ফলে তাকে সর্বক্ষণ কিতাবের পাতায় ডুবে থাকতে হয়। মহান আল্লাহ তাকে মুসলিম উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বসিয়ে সর্বক্ষণ কিতাবে ডুবে থাকা যেন তার জন্য আবশ্যক করে দিয়েছেন।

এত বিপুল পড়াশোনা আর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলেই তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলো যথার্থভাবে সম্পাদন করা। এসব কাজ ও কীর্তির জন্য মুসলিম উম্মাহ তার কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবে।

লেখক: ফারেগ- জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877